চলমান ছাত্র-বিক্ষোভ ও চার যৌক্তিক এজেন্ডা

Passenger Voice    |    ০৭:২০ পিএম, ২০২১-১২-১১


চলমান ছাত্র-বিক্ষোভ ও চার যৌক্তিক এজেন্ডা

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: 

সাম্প্রতিক সময়ে ডিজেলের দামের সূত্র ধরে ভাড়া বাড়ানো হলো। এই যে সহনীয় যাতায়াত খরচ, হাফ পাস—এর মাধ্যমে তারা ওই বিষয়টাও সামনে নিয়ে আসছে। ধরা যাক, হাফ পাস হলো; কিন্তু প্রথমেই ভাড়াটা তিন গুণ বাড়িয়ে দিলেন, তারপর হাফ পাস দিলেন। শেষ পর্যন্ত তো ভাড়া বেশিই হচ্ছে। এই মুহূর্তে তো তা-ই হচ্ছে, গত কয়েক দিনে যা দেখলাম। তাই সহনীয় যাতায়াত খরচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কোভিডকালে আমরা পিপিআরসি, বিআইজিডি গবেষণায় দেখেছি, এ সময় যাতায়াত খরচের বোঝাটাও কিন্তু বেড়ে গেছে। অন্যান্য অনেকে দেশে কোভিড-সহায়তার অংশ হিসেবে যাতায়াত খরচের বোঝাটা নিয়ন্ত্রণে রাখা তাদের অন্যতম একটা লক্ষ্য ছিল। আমাদের কিন্তু উল্টো হয়েছে। এখন সহনীয় যাতায়াত খরচ দ্বিতীয় একটা এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে।

তৃতীয় একটা এজেন্ডাও কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর কিছুটা ছাত্রছাত্রীদের আলোচনার মধ্যে আসছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশে একটা নতুন সংকট চলছে। সেটা হচ্ছে শোভন ব্যবহারের সংকট। কর্তৃপক্ষ বলতে যা বোঝায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তৃপক্ষ অথবা যানবাহনগুলোর কর্তৃপক্ষ অথবা এগুলো যারা পরিচালনা করে তাদের। এই যে শোভন ব্যবহারের অনুপস্থিতির একটা ভয়ংকর সংস্কৃতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষের সঙ্গে শোভন ব্যবহার না-করাটা যেন কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব ফলানোর একটা অবশ্যম্ভাবী দিক হয়ে উঠছে। তুই-তুকারি তো আছেই, ধাক্কাধাক্কি, গালি দেওয়া—একধরনের শোভন ব্যবহার না-করা। আমরা যাতায়াত করলে তো একা যাতায়াত করি না। আমরা বাসে উঠি, গাড়িতে উঠি, আমরা সহযাত্রীর সঙ্গে ইন্টার‍্যাক্ট করি, যারা কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে করি, পথে যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে তাদের সঙ্গে করি, নানাভাবে করি। কর্তৃপক্ষ তো বটেই, জনগণের সঙ্গেও শোভন ব্যবহারের বিষয়টা জড়িত রয়েছে। শোভন ব্যবহার কিন্তু আমাদেরও দেখানো দরকার, মানে আমরা যারা ব্যক্তিমানুষ। আজ শোভন ব্যবহারের ঘাটতি মানসম্মত জীবনযাপনের জন্য অন্যতম একটা কালো ছায়া হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। আমি বহু দেশে গিয়েছি, ওদের রাস্তাঘাট আমাদের চেয়ে চওড়া নয়। আমাদের অবকাঠামো তাদের চেয়ে কম নয়। কিন্তু শোভন ব্যবহারের জায়গাটায় আকাশ-পাতাল তফাত। কেন হবে? পঞ্চাশ বছরের স্বাধীন দেশে এই শোভন ব্যবহারের সংস্কৃতিটা গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে ছাত্রছাত্রীদের দাবিতে তা সরাসরি না-এলেও এটাও একটা বিষয়। আমি মনে করি, নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে শোভন ব্যবহারের বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। আর পুরুষ সহযাত্রীর অনেকের মধ্যেও এ ঘাটতি আছে।

চতুর্থ বিষয়টা হচ্ছে, যেকোনো দেশে কিছু করতে আইনের প্রয়োজন হয়। আইনি কাঠামোর মধ্যেই তো আমাদের চলা উচিত, দেশ পরিচালিত হওয়া উচিত। সড়ক নিয়ে আইনি কাঠামোর এই জায়গায় কিন্তু সাংঘাতিক ঘাটতি আছে। ১৯৮৩ সালের যে মোটর ভেহিক্যাল অর্ডিন্যান্স, যেটা আবার অনেক পুরোনো। এটাকে হালনাগাদ করে ২০১৮ সালে দুটি পরিবহন আইন করা হলো। সেখানেও বেশ কিছু ঘাটতি আছে। তারপরও আইন তো হয়েছে। কিন্তু এটার সঠিক বাস্তবায়ন আটকে আছে। চার নম্বর সংকট হচ্ছে—আইনি কাঠামোর বাস্তবায়ন। এটিও বিভিন্ন জায়গায় আটকে আছে। আসল ক্ষমতাধর কারা? রুট পারমিট দেওয়ার জায়গাটা বা রুট পারমিটটা হচ্ছে একধরনের রূপক অর্থে সড়ক কুশাসনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে একধরনের যোগসাজশ রয়েছে, যেটায় কিছু স্বার্থের দুষ্টচক্র রয়েছে। সেই অর্থে গোষ্ঠীস্বার্থ এবং জনস্বার্থ একদম মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে এবং গোষ্ঠীস্বার্থই কিন্তু প্রশ্রয় পাচ্ছে। আইনের কাছে প্রশ্রয় পাচ্ছে। দৃশ্যত মনে হচ্ছে, সরকারের কাছেও প্রশ্রয় পাচ্ছে। জনস্বার্থের বিষয়টা ওই অর্থে সেভাবে প্রশ্রয় পাচ্ছে না।

এই যে চারটা বিষয় বললাম, একটা হচ্ছে সড়ক নিরাপত্তা; দ্বিতীয়ত, সহনীয় যাতায়াত খরচ; তৃতীয়ত, শোভন ব্যবহার এবং চতুর্থত, আইন বাস্তবায়নে ঘাটতি—এই চারটি মিলে আসলে এমন একটা অবস্থানে আছি আমরা, এটা নজরে আনার প্রয়োজন। এটার জন্য ছাত্ররা আন্দোলন করছে; কিন্তু তাদের আন্দোলন আসলে সবার জন্য। আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা, তা পূরণের জন্য যে ধরনের অর্থনীতি আমরা চাই, তার জন্য যাতায়াত খাতটা মানানসই করে তুলতে হবে। সে কারণেই এ জায়গা থেকে আমাদের বিষয়গুলো নজর দেওয়া দরকার।

বেশ কয়েক বছর আগে প্রিমিয়াম বাস বলে একটা সেবা চালু হয়েছিল। উত্তরা থেকে মতিঝিল। ঢাকাতেই আমরা দেখেছিলাম, একধরনের সংস্কৃতি গড়ে উঠছিল যে, সবাই নিয়ম করে লাইনে দাঁড়াত। ওটা চলে গেল কেন? শুধু বাসটা নয়, ওটার আশপাশে মানুষ যদি সঠিক সংকেত পায়, তার ব্যবহারিক জায়গাটাকেও সে উন্নত করতে পারে, ধাক্কাধাক্কি না-করে নিয়ম করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। ঢাকা শহরেই আমরা করেছি। এটা ছিল মানসম্মত সেবা। এটা কেন হারিয়ে গেল?

এখানে আরও একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ– ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। এই জায়গাটাও কিন্তু নজরে আনা জরুরি। ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অদ্ভুত কিছু বৈপরীত্য আমরা দেখি। এত টাকা খরচ করে রোড সিগন্যালিং বাতি বসানো হলো। কিন্তু যান নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে হাত দিয়ে, বাতি দিয়ে নয়। তাহলে বাতি কেন বসানো হলো? সেফ রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অ্যালায়েন্স থেকে একটা প্রস্তাব ছিল যে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টা এখন যেভাবে কাজ হচ্ছে, এটা হচ্ছে পুলিশের একটা বাড়তি দায়িত্ব। কোনো স্পেশালাইজড টিম এখানে নেই। বাংলাদেশে এখনো কেন ন্যাশনাল ট্রাফিক একাডেমি নেই? ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা তো মহাবিশ্বের কোনো সমস্যা নয়। বিভিন্ন দেশ ব্যবস্থাপনা করছে। এটা করা যে অসম্ভব কিছু, তা-ও তো নয়। যদি সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হয়, তাহলে সুনির্দিষ্টভাবে খতিয়ে দেখা করা দরকার।

আরেকটা হচ্ছে, তদারকি। পঞ্চাশ বছরের মাথায় দাঁড়িয়ে এটা আর মেনে নেওয়া যায় না। এমন একটা মনোভাব যেন এটা ধারাবাহিকভাবে চলবে। মাঝে মাঝে একটু নড়াচড়া হবে। আমি মনে করি, ছাত্রছাত্রীদের যুক্ত হওয়াটা বিষয়টাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। নতুনভাবে একটা নৈতিক আবেদন তৈরি করেছে। সেখানে এই চারটা বিষয়—নিরাপত্তা, শোভন ব্যবহার, সহনীয় যাতায়াত খরচ এবং সঠিক আইনি কাঠামো ও তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন—এই চারটা মিলে তার আওতায় আরও বাড়তি এজেন্ডা ম্যানেজমেন্টের একটা বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ। এগুলো করা অত্যন্ত জরুরি। নইলে যেটা হচ্ছে, পরিসংখ্যানের দিক থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ঢাকা শহরে অবকাঠামো বাড়ছে, অবকাঠামোর খরচ বাড়ছে; কিন্তু ভ্রমণের সময় কমছে না। এখন হেঁটে যাওয়া আর গাড়িতে যাওয়ার গতি প্রায় এক রকম হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা শহর কিংবা চট্টগ্রামও যদি মনে করি, কিছুতেই সেই সময় কমানো যাচ্ছে না। একটা দক্ষ ও কার্যকর যাতায়াত খাত একটা অর্থনীতির স্তম্ভ। সেখানে এই বিষয়গুলো অত্যন্ত জরুরি।

সার্বিকভাবে আমি মনে করি, সড়ক নিরাপত্তা ও হাফ পাস একটা নির্দিষ্ট ইস্যু, তার মাধ্যমে কিন্তু একটা বড় ধরনের সংকেত দিচ্ছে। আমি আশা করি, সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ এটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার। এটার অন্তর্নিহিত বার্তাই হলো বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং উন্নত সমাজের অর্জনে করণীয় কী তার বার্তা। আমাদের যে কর্তৃপক্ষ আছে, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তারা বার্তাগুলোকে তাদের একমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সেই অর্থে জনগণকে চিনতে মনে হয় ভুলে গেছে কর্তৃপক্ষ। কেউ কিছু বললেই তারা তাকেই ভাবছে প্রতিপক্ষ। বাংলাদেশে যে মানুষ আছে, জনগণ আছে; জনগণকে চেনার সংস্কৃতিটা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। যারা ক্ষমতায় আছে, কর্তৃপক্ষ আছে, তারা দাবি-দাওয়ার বিষয়টাকে প্রতিপক্ষ ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। জনগণকে প্রতিপক্ষ ভাবার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এটা উচিত নয়। নৈতিক জায়গা থেকে এটা কোনোভাবেই হতে পারে না। কারণ, জনগণের প্রয়োজনগুলোর প্রতিনিধিত্বের জন্যই তারা ওখানে আছে। শোনার মানসিকতা যে হারিয়ে যাচ্ছে, সেটাও বলা প্রয়োজন। যারা ক্ষমতার চর্চা করছে, তাদের কিন্তু শুনতে হবে। কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের পার্থক্য বোঝাটাও জরুরি হয়ে পড়েছে।